সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২০ অপরাহ্ন
।। আওরঙ্গজেব কামাল, কালের খবর ।।
পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে দেশে মাদক ঢুকছে। আর এই মাদকের কবলে পড়ে দেশের যুব সমাজ একেবারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১ কোটি লোক মাদকাসক্ত।একটি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। একটি দেশের যুবসমাজ জাতির প্রাণশক্তি। যুবসমাজের উপর নির্ভর করছে জাতির সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতি। বাংলাদেশ গঠন ও উন্নয়নে যুবসমাজের গৌরবজ্জ্বোল ও সাহসী ভূমিকা অনস্বীকার্য। অথচ এ যুব সমাজের একটি বিশাল অংশ মাদকের নেশায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। যে পরিবারে একজন তরুণ মাদকাশক্ত হয়েছে সে পরিবারের দু:খ দুর্দশার শেষ নেই। অনুসন্ধানে জানাযায়,শুধুমাত্র বাংলাদেশী মাদক ব্যবসায়ীদের চাহিদা মেটাতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে নকল ফেনসিডিলের অসংখ্য কারখানা। প্রতিদিনের চাহিদানুযায়ী যার উৎপাদন প্রায় ২ থেকে ৩ লাখ লিটার। এসব কারথানায় উৎপাদিত ফেনসিডিল ভারতীয় মাফিয়া চক্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পৌঁছে দিচ্ছে। পরবর্তীতে এ সকল ফেনসিডিল দেশীয় চোরাচালানীরা নিত্য নতুন কৌশলে ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশের অভ্যন্তরের তৃণমূল পর্যায়ে। এ জন্য ভারতের সীমান্তে গড়ে ওঠা ৩০৯টি ফেনসিডিল কারখানা ধ্বংস করতে বারবার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে। মাস দুয়েক আগে ৫০টি কারখানা ধ্বংস করা হয়েছে বলে ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে । একাধিক সুত্র জানায়,সীমান্ত থেকে পাঁচ-সাত কিলোমিটারের মধ্যে গড়ে ওঠা কারখানা থেকে ফেনসিডিল চালান নানা পথে ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশে। ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ফেনসিডিল দেশে ঢুকছে বলে বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানে দেখা গেছে। ভারতের আসাম-মেঘালয়ের বাংলাদেশ সংলগ্ন এলাকাগুলোর ৪টি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে কুড়িগ্রাম, শেরপুর, ময়মনসিং ও নেত্রকোনায়। এছাড়া সাতক্ষীরা,যশোর,মেহেরপুর,খুলনা, দিনাজপুরসহ ৬১২টি পয়েন্ট ফেনসিডিল ব্যবসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। কারখানাগুলো বন্ধ করতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। কিন্তু তাতে প্রত্যাশিত সাড়া মেলেনি। বছরে ৩ কোটি বোতল ভারতীয় ফেনসিডিল বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৮শ’ কোটি টাকা। তবে অনুমান করা যেতে পারে, প্রতি বছর এ বিপুল পরিমাণ ফেনসিডিল চোরাচালানে অন্তত ১৫০০ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে কালোবাজারে। এসব ফেনসিডিলের ৭০ ভাগই বিক্রয় হচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ বড়বড় শহরগুলিতে। দিনাজপুর থেকে সুন্দরা, দায়নুর, ফুলবাড়ী ও কাটলা সীমান্ত বাড়ী,যশোরের বেনাপোল,সাতক্ষীরার ভোমরা এলাকা দিয়ে বেশির ভাগ ফেনসিডিল এসে থাকে। পক্ষান্তরে আইন-শৃংখলা বাহিনী এ বিপুল পরিমাণ মাদকের কমই উদ্ধার করতে পারছে বলা যায়, ফেনসিডিলিন চোরাচালান রোধে তারা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছেন বল্লেও ভূল হবেনা। সরেজমিন ও বিভিন্ন তথ্য অনুসন্ধান করে জানা গেছে, মাদকাসক্তদের কাছে অঞ্চলভেদে ফেনসিডিলের অপর নাম ‘ডাইল, ফান্টু, মধু বা জুস’বলে পরিচিত। দেশের অভ্যন্তরে শহরাঞ্চল ছাড়াও তৃণমূল পর্যায়ে গড়ে উঠেছে ডাইল পট্টি। স্থানভেদে মাদকাসক্তদের কাছে এখন ‘ফেনসিডিল, ডাবুর ও হেরোইন’ইয়াবা,বাবা সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। একাধিক সূত্র জানায়, দুই পাড়ের প্রশাসনিক তৎপরতার ওপর নির্ভর করে মাদকদ্রব্যের দরদাম উঠা-নামা। চারিদিকে এখন শুধু ফেনসিডিল আর হেরোইন,বাবার ছড়াছড়ি। জানা গেছে, দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত এলাকার দৈর্ঘ্য প্রায় ৬শ কিলোমিটার। সুন্দরবন এলাকার রায়মঙ্গল নদীর কাছে কৈখালী থেকে কুষ্টিয়ার হার্ডিং ব্রীজ পয়েন্ট পর্যন্ত এই দীর্ঘ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে রয়েছে অসংখ্য চোরাচালান ঘাট। উভয় সীমান্তে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর টহল শিথিল হলেই বানের পানির মত মাদক বিক্রেতারা প্রবেশ করে। অভাবী শিশু, কিশোর ও মহিলাদের কাজে লাগানো হচ্ছে মাদকদ্রব্য পারাপারে। ব্যাপক তথ্যানুসন্ধানে আরো জানা যায়, ৯০ এর দশক থেকে মূলত ভারত থেকে বাংলাদেশে ব্যাপক ভাবে মাদকদ্রব্য আসা শুরু হয়। ভারতের মুম্বাই থেকে রোনপোলেঙ্ক কোম্পানী কফ সিরাপ হিসেবে ফেনসিডিল বাজারজাত করে বেশ আগে থেকেই। ফেনসিডিলে নেশা হয় এ কথা জানতে পেরে তারা তাতে এ্যালকোহল’র মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। চাহিদা এবার তুঙ্গে চলে যায়। এক পর্যায়ে তা হয় নিষিদ্ধ। কিন্তু উৎপাদন বন্ধ হয়নি এক দিনের জন্য হলেও। পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের নেশাখোরদের কাছে ফেনসিডিলের চাহিদা বাড়তে থাকলে পাচার ও বেড়ে যায় বহুগুনে। সেই থেকে ফেনসিডিল আসছে তো আসছেই। এমন কোন দিন নেই যে মাদকদ্রব্য অভ্যন্তরে ঢুকছে না। সাতক্ষীরার ভাদিয়ালী, বড়ালী, চারাবাড়ী, গাড়াখালী, হিজলদী, চান্দুড়িয়া, যশোরের সাদীপুর, বড় আঁচড়া, শিখারপুর, মাসিলা, ঝিনাইদহের যাদপুর, সীামান্ত, চুয়াডাঙ্গার জীবন নগর রাজাপুর, দর্শনা, মেহেরপুরের গাংনী, মজিবনগর, কুষ্টিয়ার দৌলতপুরসহ দক্ষিণ পশ্চিাঞ্চলের বিভিন্ন ঘাট এলাকা দিয়ে বিভিন কৌশলে আসে ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন প্রকার মাদকদ্রব্য। ঘাট এলাকা থেকে ফেন্সিডিল নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে ব্যবহার করা হয় বাস ট্রাক, ট্রেন, মাইক্রো, প্রাইভেটকার, মোটর সাইকেল ও সর্বপরি পথচারী বেশে লোকদের বাজাারের ব্যাগে। বর্তমানে ফেন্সিডিল পাচারে দেশের অভ্যন্তরে ব্যবসায়ীরা নিত্য নতুন সব কৌশল অবলম্বন করছে। প্রায়ই ধরাও পড়ছে তারা। কিন্তু এক দিনের জন্য হলেও বন্ধ হয়নি ব্যবসা। শুধুমাত্র মাঝে মধ্যে স্পট পরিবর্তন হয়। বেনাপোল, মহেশপুর, চৌগাছা, সামান্তা, রাজগঞ্জ, কেশবপুর, তালা, পাইকগাছা, পাটকেলঘাটা, দর্শনা, জীবননগর, মেহেরপুর, কলারোয়া, দৌলতপুর, যুগিবাড়ী, বোয়ালিয়া, পাঁচপোতা, বেলেডোঙ্গা, সোনাবাড়িয়া, বুচতলা, রয়েরডাঙ্গা, রামভদ্রপুর, গয়ড়া, কাজিরহাট, ঠাকুরবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য ফেনসিডিলের চোরা গুদাম বা আড়ৎ রয়েছে।বিভিন্ন সময় বিডিআর পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর হাতে বিপুল পরিমান ফেন্সিডিল ও চোরাচালানীসহ ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ আটক হলেও তা বন্ধ করা যায়নি। বরং সংশ্লিষ্ট চোরা চালানীরা নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করছে। সেক্ষেত্রে ডিম, মাছ, বোঝাই পিকআপ, কুরিয়ার সার্ভিস, সবজির মধ্যে, ঢুকিয়েও পৌঁছে দেয়া হচ্ছে ফেনসিডিল ও বাবা ট্যাবলেট। বাংলাদেশে ফেনসিডিলের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের রোনপুলেঙ্ক ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের বনগাঁ, রানাঘাট, কৃষ্ণনগর, বানপুর, বহরমপুর ও বারাসাতসহ বিভিন্ন স্থানে নকল ফেনসিডিলের কারখানা রয়েছে। যেখানে থেকে প্রতিদিন নাকি চাহিদানুযায়ী ২/৩ লাখ লিটার ফেন্সিডিল উৎপাদন হয়। যা কিনা বোতলজাতের পাশাপাশি ড্রামে ভর্তি হয়ে এপারে আসে এবং নিরাপদ স্পটে রেখে তা বোতলজাত হয়। সূত্র জানায়, ভারতীয় দামের তুলনায় বাংলাদেশে ১ বোতল ফেন্সির দাম ৪ গুণ। বর্তমানে বাংলাদেশে এক বোতল ফেন্সির দাম রাখা হচ্ছে ২৭০-৭০০ টাকা পর্যন্ত, স্থান ভেদে এর দাম আরও বেশী। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, অতিরিক্ত ফেনসিডিল সেবনে কর্মশক্তি ও উদ্যম হারিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে তিলে তিলে জীবনের আলো নিভে যায়। তাদের মতে আসল ফেন্সির চেয়ে নকল ফেন্সি আরো বেশি ক্ষতিকারক। জানা গেছে, ফেন্সিডিলে রয়েছে কোডিন, ফসফেট, গোম্যাথাজিন, হাইড্রোক্লোরাইড ও অক্সিজেন হাইড্রোক্লোরাইড। শরীরের ভেতর এই কোডিন ফসফেট বেশি বেশি পরিমান প্রবেশ করলেই নেশা হয়। নিয়মিত ফেন্সি সেবনে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়। হরমনের বিকৃতিতে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়। স্কুল-কলেজ পড়–য়া ছাত্র থেকে শুরু ূকরে ভ্যান চালক ব্যবসায়ীসহ কর্মজীবি বিভিন্ন শ্রেণী পেশা ও বয়সের মানুষেরা ক্রমাগত ফেন্সিডিল,বাবা ও হেরোইনে আসক্ত হয়ে ধাবিত হচ্ছে ধ্বংসের দিকে। দেশের তরুণ প্রজন্মের এক চতুর্থাংশ কোনো না কোনো ধরনের নেশায় আসক্ত।” অনুসন্ধানী এ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের ১৭ জনের একজন তরুণ মাদকাসক্ত। ছিন্নমূল শিশু কিশোররাও জুতা তৈরি গাম দিয়ে নিয়মিত নেশায় মত্ত রয়েছে। এক গবেষণায় দেখা যায়,৫৭ শতাংশ মাদকাসক্ত নানা অপরাধে জড়িত। আবার তাদের ৭ শতাংশ এইচআইভি ভাইরাসে সংক্রমিত। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী দেশে এখন পর্যন্ত ২৪ ধরনের মাদক উদ্ধার হয়েছে। তবে দেশে ৩২ ধরণের মাদক সেবন হয় বলে একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে।গবেষণায় বলা হয়,দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বেশিরভাগ মাদক। মাদকের প্রবেশ পথ হিসেবে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন ৩২টি জেলাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে।
এরমধ্যে বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের হাসনাবাদ, ঢাকি, বসিরহাট, পেট্রাপোল, বাদুড়িয়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা, বনগাঁও, স্বরূপনগর, হেলেঞ্চা, ভবানীপুর, রানাঘাট, অমৃতবাজার, বিরামপুর, করিমপুর, নদিয়া, মালদহ, বালুরঘাট, আওরঙ্গবাদ, নিতিতাসহ সীমান্ত সংলগ্ন প্রায় সব এলাকার দিয়ে ১৫টি পয়েন্টে বাংলাদেমের সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেরেপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর এলাকার মাদক ঢুকছে।ভারতের আসাম-মেঘালয়ের বাংলাদেশ সংলগ্ন এলাকাগুলোর ৪টি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে কুড়িগ্রাম, শেরপুর, ময়মনসিং ও নেত্রকোনায়। বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মিজোরামের ৪টি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও ফেনীতে। এ ছাড়া ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর হয়ে বাংলাদেশের নওগাঁয় ফেনসিডিল পাচারের নতুন রুটের সন্ধান পাওয়া গেছে।মিয়ানমারের সঙ্গে মাত্র ২৭১ কিলোমিটারের সীমান্তে সবচেয়ে সক্রিয় মাদক রুটগুলো গোটা দেশে মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কক্সবাজার ও পার্শ্ববতী বান্দরবানের ঘুমধুম, নাইক্ষ্যংছড়ি, দমদমিয়া, জেলেপাড়ার প্রায় অর্ধশত স্পট দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে। ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা, আইস কোনটিই দেশে উৎপাদিত না হলেও তা পাওয়া যাচ্ছে যত্রতত্র। তার মানে কি এই নয় যে, আমাদের সীমান্ত।বাংলাদেশের মতো বিশ্বের বহু দেশে মাদকের অবৈধ ব্যবহার বাড়ছে। এতে জাতিসংঘও ((United Nations) উদ্বিগ্ন। এ ব্যাপারে এই মুহুর্তে প্রশাসনের পাশাপাশি প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন জোরদার, নয়তোবা ধ্বংসের দিকে দ্রুত ধাবিত হবে যুব সমাজ এমন মন্তব্য অভিভাবকসহ সচেতন মহলের।